এই সপ্তাহে ভুটানের বিদেশমন্ত্রী তান্ডি দর্জির চীন সফর নানা দিক থেকেই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও নজিরবিহীন বলা যায়। ভুটান এবং চীনের মধ্যে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। এই প্রথম ভুটানের কোনো বিদেশমন্ত্রী চীনের মাটিতে পা রাখলেন। দর্জির এই সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল সীমান্ত নিয়ে চীনের সাথে আলোচনায় বসা। প্রসঙ্গত, বিগত সাত বছরেরও বেশি সময় ধরে সীমান্ত বিষয়ক আলোচনা বন্ধ ছিল। এবারের আলোচনা ফলপ্রসু হয়েছে। একটি যৌথ বিবৃতি অনুযায়ী, সীমানার ডিলিমিটেশন এবং ডিমারকেশনের জন্য একটি নতুন যৌথ টেকনিক্যাল টিমের কার্যপ্রক্রিয়ার বিশদ বিবরণ উল্লেখ করা সহযোগিতামূলক চুক্তিতে দুই দেশ স্বাক্ষর করেছে। দর্জির সাথে আলোচনার সময় চীনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন এবং সীমানা সংক্রান্ত বিষয়ের সমাধান করার আহ্বান জানিয়েছেন। ভারতের সাথে ভুটানের একটা বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। এই অবস্থায় চীন এবং ভুটানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন এবং সীমান্ত চুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে ভারতের বরাবরই একটা উদ্বেগ ছিল। তবে সেই উভয় পরিণামই ক্রমশ অপরিহার্য বলে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই মাসেই এই সংবাদপত্রে এক সাক্ষাৎকারে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, দুই দেশই সীমান্তের বিশদ বর্ণনা এবং ডিমারকেশন সংক্রান্ত একটি তিন-ধাপের রোড ম্যাপের কাজ সম্পূর্ণ করার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তিনি আরও দাবি করেন, চীনের সাথে কোনো চুক্তি না করলে তা ভারতের স্বার্থের পরিপন্থী হবে।
নানা বিষয়ে ভারতের ওপর ভুটান নির্ভরশীল। তাই চীনের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে ভুটান যে নয়াদিল্লিকে আগেভাগে এটি জানিয়েছে, সে ব্যাপারে খুব একটা সন্দেহ নেই। এর বদলে ভারতের নিরাপত্তা সংক্রান্ত স্বার্থ অক্ষুণ্ণ থাকার পাশাপাশি ভারতে রেড লাইন বা সীমান্ত সংক্রান্ত চূড়ান্ত রেখা নিশ্চিত হবে। এমনই একটা রেড লাইন হলো সাউদার্ন ডোকলামের শৈলশিরা থেকে চীনকে দূরে রাখা। এখান থেকেই ভারতের “শিলিগুড়ি করিডোর” দেখা যায়। এদিকে বেজিং এবং থিম্পু উত্তরের ভ্যালিতে ভুখণ্ড “অদলবদল” করার কথা বিবেচনা করছে, যেখানে ভুটান ক্রমশ চীনা চাপের মুখোমুখি হয়েছে। পশ্চিমে ডোকলাম মালভূমিতেও একই অবস্থা। এছাড়া চীনের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে তোলার জন্য থিম্পু ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করতে পারে, ভুটানে চিরস্থায়ী চীনা কূটনৈতিক উপস্থিতির দরজা খুলে দিতে পারে। এর পাশাপাশি সীমান্ত সংক্রান্ত আলোচনাও চলবে। এখন নয়াদিল্লির সামনে যে প্রশ্নটা ঘুরছে, তা হলো নিজেদের স্বার্থ কীভাবে সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়ে সুরক্ষিত রাখা যায়। ২০১৭ সালে ভারত-চীনের ডোকলাম বিরোধ থেকে থিম্পুর ব্যাপারে একটা শিক্ষা হয়েছে যে, ভুটানকে পাশে রেখে এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ কৌশল গ্রহণ করলেই ভারতের স্বার্থ চরিতার্থ হবে। একটি সার্বভৌম দেশের কাছ থেকে নীরব বশ্যতার প্রত্যাশা করা যায় না। তার কারণ তাদেরও নিজস্ব লক্ষ্য থাকে। উত্তরে ভুটানের উদ্বেগ মেটানোর পাশাপাশি পশ্চিমে ভারতের রেড লাইন সংরক্ষণ করা সীমান্ত সংক্রান্ত একটি চুক্তি নয়াদিল্লির স্বার্থকে ক্ষুণ্ণ করবে, তা হলফ করে বলা যায় না। উদ্বেগের পরিবর্তে ভুটানের যুক্তি ভালোভাবে বুঝে নিয়ে তবেই ভারতের সীমান্ত সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনার ব্যাপারে অগ্রসর হওয়া উচিত। ভারতের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত প্রতিবেশী রাষ্ট্র যে ভারতের এবং নিজেদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করার পরেই যে কোনো চুক্তিতে আবদ্ধ হবে, এমন আত্মবিশ্বাস থাকাও প্রয়োজন।