চলতি সপ্তাহে রাশিয়া সফরে গিয়েছিলেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর। বৈঠকগুলোকে সফল এবং ইতিবাচক করে তোলার জন্য নয়াদিল্লি এবং মস্কো যে প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে, তা থেকে এই সমগ্র বিষয়টির গুরুত্ব আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পাঁচ দিনের সফরটি ভারতের বর্ষ শেষের কূটনৈতিক ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার। এটা মাথায় রাখতে হবে, সাধারণত রাশিয়াতে ছুটির মরসুম শুরু হওয়ার আগে, বিদেশী প্রতিনিধি দলের এত লম্বা সফরে ক্রেমলিনের নেতৃত্বকে যোগদান করতে দেখা যায় না। এছাড়া, আরও একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার হলো, জয়শঙ্করের মতো, অপেক্ষাকৃত নিচের দিকে থাকা পদমর্যাদার বিদেশ কর্মকর্তার সাথে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বৈঠক করেন না। যে উষ্ণতা প্রদর্শন করা হয়েছে, তা বেশ উল্লেখযোগ্য ব্যাপার। ২০০১-২১ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে বজায় রাখা বার্ষিক লিডারশিপ সামিটের ঐতিহ্য এই নিয়ে দুই বছরের জন্য এড়িয়ে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাই ইউক্রেন যুদ্ধের পর ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের সমীকরণ বদলে গিয়েছে কি না, তা নিয়ে বিশাল কৌতূহল তৈরি হয়। ভারত অতি সচেতনভাবে রাশিয়াকে সমালোচনা না করার ওপর নজর দিয়েছে। এর পাশাপাশি নিরাপত্তা সরঞ্জাম হ্রাস পাওয়া, আমদানির জন্য তৃতীয় মুদ্রায় পেমেন্ট সংক্রান্ত সমস্যা এবং দ্বিপাক্ষিক এনগেজমেন্ট সংক্রান্ত অন্যান্য ক্ষেত্রে সাধারণ ছবিটা নিম্নমুখী হওয়া কারণে উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল। এটা স্পষ্ট যে জয়শঙ্করের মিশনের একটা অন্যতম অংশ ছিল ধারণাগত পার্থক্যগুলো দূর করা। তবে ভবিষ্যতের কুড়ানকুলাম পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পে সহযোগিতা বৃদ্ধি, যোগাযোগ মজবুত করা, বাণিজ্য এবং ইউরেশিয়ান ইকনমিক ইউনিয়ান-ভারত ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্টের জন্য আলোচনা শুরু করা এবং যৌথ সামরিক উৎপাদন নিয়ে যে কথাবার্তা এবং চুক্তি হয়েছে, তা থেকে এটা স্পষ্ট যে দুই দেশের সম্পর্ক সঠিক পথেই রয়েছে। মাল্টিল্যাটারেল সহযোগিতা, বিশেষত যখন পরবর্তী বছরের ব্রিকস সম্মেলনের আয়োজন করতে চলেছে এবং ভারত ও রাশিয়া রাষ্ট্রসংঘ এবং এসসিওতে অবস্থানের ব্যাপারে সামঞ্জস্য বজায় রেখে চলেছে, সেক্ষেত্রে এটিও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। পশ্চিমি দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও যেভাবে জয়শঙ্কর ঘোষণা করেছেন যে রাশিয়ান হাইড্রোকার্বন আমদানি চলতে থাকবে, তা থেকে বোঝা যায় রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যেই দুই দেশের সম্পর্কের ভিত অক্ষত রয়েছে।
জয়শঙ্কর নিশ্চিত করেছেন যে ২০২৪ সালে বার্ষিক নেতৃত্ব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এটি থেকে বোঝা যায়, দুই দেশই নিজেদের সম্পর্কে যদি কোথাও স্থিতিশীলতা তৈরি হয়ে থাকে, তা দূর করার জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। তিনি এও মন্তব্য করেছেন, বিগত ছয় দশক থেকে বিশ্ব রাজনীতিতে একমাত্র অপরিবর্তনীয় বিষয় হলো ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক। এটা ওয়াশিংটন এবং বেজিংয়ের যে নজর এড়িয়ে যায়নি, তা বলতেই হবে। সামরিক সম্পর্ক নিয়ে তৈরি হওয়া অচলাবস্থার মধ্যে দিয়ে ভারত-চিন সম্পর্কের আরও একটা বছর অতিবাহিত হয়েছে। সাধারণতন্ত্র দিবসের অতিথি হওয়ার জন্য মোদীর আমন্ত্রণ গ্রহণ করেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। পান্নুনের তদন্ত নিয়ে ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে একটা হালকা আলোড়ন তৈরি হয়েছে। এই ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে, ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের অবস্থান বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তবে দুই দেশের এই ঘনিষ্ঠতার ফলে রুপি-রুবেল পেমেন্ট পদ্ধতি সংক্রান্ত সুফল পাওয়া যায় কি না অথবা এস-৪০০ এয়ার সিস্টেম ইউনিটের বিলম্বিত ডেলিভারিতে গতি আনা যায় কি না, তা এখন দেখার বিষয় হয়ে উঠেছে। তবে, এই সফরের বৃহত্তর তাৎপর্য এবং একটি মাল্টিপোলার বিশ্বের ভারত এবং রাশিয়ার মধ্যে জিওপলিটিক্যাল এবং কৌশলগত একত্রীকরণ রিব্যালেন্সিং পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে বলে তিনি যে মন্তব্য করেছেন, তার উপর এই সম্পর্কটির বিভিন্ন কেন্দ্র ও সমালোচকদের দিক থেকে কড়া নজর রাখা হবে।