রিসেপ তায়িপ এরডোগানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) ২০০২ সালে যখন ক্ষমতায় আসে, তখন তিনি অর্থনৈতিক দুর্দশার মাঝে প্রতিষ্ঠানবিরোধী ক্ষোভকে সম্বল করে জয়ী হয়েছিলেন। কেমালিস্ট ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের প্রাধান্যযুক্ত একটি সিস্টেমে তিনি ছিলেন রাজনৈতিকভাবে একজন বহিরাগত - একজন ইসলামিস্ট। কুড়ি বছর পরে এরডোগান নিজের পায়ের তলায় মাটিকে আরও শক্ত করে তুলেছেন। পুরানো শাসনব্যবস্থার মূল হোতা হিসাবে পরিচিত সেনা এখন তার হাতের মুঠোয়। প্রতিষ্ঠানগুলোও তার অঙ্গুলি হেলনে চলে। উলেমার সাথে ঘনিষ্ঠ সংযোগ থাকা একেপি এখন একটি মজবুত রাজনৈতিক মেশিনে পরিণত হয়েছে। তবে ২০২৩ সালে যে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেটাকে ২০০২ সালের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। শোচনীয় হতে থাকা অর্থনৈতিক সঙ্কট, গণতন্ত্রের ভীত ও স্বাধীনতাকে দুর্বল করে দেওয়ার অভিযোগের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার দল। দীর্ঘদিন ধরে তার ক্ষমতায় থাকা নিয়েও ক্ষোভের আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। বিরোধী শিবির এই ক্ষোভকে কাজে লাগাতে মরিয়া। গত ১৪ মে তারা তাকে প্রথম রাউন্ডের জয় থেকে বঞ্চিত করতে সক্ষমও হয়। তবে রবিবারের চূড়ান্ত পর্যায়ের নির্বাচনে তিনি ৫২.১% ভোট শেয়ার নিয়ে জয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কামাল কিলিচদারগলু ৪৭.৯% ভোট পেয়েছেন। কিলিচদারগলু ভোটের এই ফলাফল স্বীকার করে নিয়েছেন। তবে তিনি তিনি এও দাবি করেছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে এবারের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি কারচুপি হয়েছে। তার দাবি একদম উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এরডোগান এবং তার সঙ্গীরা বড় বড় মিডিয়া সংস্থাগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন। তথ্য পরিবেশনে তারাই শেষ কথা। ইমাম নিয়োগ এবং মসজিদ নিয়ন্ত্রণের কাজে যুক্ত রিলিজিয়াস ডিরেক্টরেট (ডিয়ানেট) সহ দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো একেপির প্রপাগান্ডাকে জোরালো করেছে। প্রেসিডেন্টের অভিযোগ, সন্ত্রাসবাদীদের সাথে বিরোধীদের আঁতাত রয়েছে। এর কারণ তার প্রতিদ্বন্দ্বী কিলিচদারগলুকে একটি মূল ধারার কুর্দিশ পার্টি সমর্থন করছিল। তিনি একজন প্রাক্তন আমলা। তিনি সংখ্যালঘু আলেভি কমিউনিটি থেকে উঠে এসেছেন। তিনি ব্যাপক উদ্দীপনা নিয়ে ভোট প্রচার চালালেও একেপির ইসলামিস্ট জনপ্রিয়তাকে পরাজিত করতে পারেননি।
মুস্তাফা কেমাল আতাতুরকের পর এরডোগানকে সবচেয়ে শক্তিশালী তুর্কি নেতা বলে বিবেচনা করা হয়, যিনি গত ২০ বছর ধরে দেশটির রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রেকে বদলে দিয়েছেন। কেমাল আতাতুরক ওটোমান খেলাফতকে নির্মূল করেছিলেন এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ধর্মযাজকদেরকে তিনি দেশের জন্য পরিপন্থী হিসাবে মনে করতেন। তুরস্কের আধুনিক ইতিহাসে সব সময়ই কেমালিজম এবং ইসলামিজমের মধ্যে চাপা উত্তেজনা ছিল। তবে এরডোগানের ক্ষমতায় উত্থানের আগে পর্যন্ত কোনো ইসলামিস্ট নেতা সিস্টেমের মুখ ঘুরিয়ে দিতে পারেননি। এটি করে তিনি বিপুল ক্ষমতা অর্জন করেছেন, সংবিধান নতুন করে রচনা করেছেন, দেশটিকে একটি এগজিকিউটিভ প্রেসিডেন্সিতে পরিণত করেছেন, নিজেকে সর্বকালের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রেডিসেন্ট হিসাবে নির্বাচিত করার ব্যবস্থা করেছেন, বিক্ষোভকে দমিয়ে দিয়েছেন, কুর্দিশ বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াইকে শক্তিশালী করেছেন এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে জেলে ভরে দিয়েছেন। এত কিছু করার পরেও এই নির্বাচনটি তার কাছে একটি অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। ঘটনা হলো, তাকে জয়ের জন্য দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে হয়েছে এবং তিনি মাত্র তিন পয়েন্টের লিড পেয়েছেন। এর ফলে তাকে মাথায় রাখতে হবে, তুরস্কের জনগণ আড়াআড়িভাবে ভাগ হয়ে গিয়েছেন। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে থাকা অর্থনীতির হাল ফেরাতে হবে। এরডোগানের আমলে একনায়কতন্ত্রের প্রবণতা এবং অর্থনীতি পরিচালনায় অদক্ষতা স্পষ্ট হয়েছে। নির্বাচনে জিতে নতুন মেয়াদ পেয়ে তিনি সেই ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার একটা সুযোগ পাবেন এবং দেশকে নতুন দিশা দেখাতে পারবেন। তবে তুরস্কের ইসলামিস্ট নেতৃত্ব এই ধরনের পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত কি না, সেটা স্পষ্ট হয়নি।