জি-৭ বা বিশ্বের তথাকথিত, সবচেয়ে বেশি শিল্পায়ন হওয়া দেশগুলোর এবারের মিটিং হিরোশিমাতে আয়োজন করা হয়েছে। উদ্যোক্তা সেই শহরেরই বাসিন্দা, জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিডা। এই উদ্যোগের মাধ্যমে তিনি গোটা বিশ্বে শান্তির জন্য আন্তর্জাতিক সহমমর্মিতার একটি বার্তা দিতে চেয়েছেন। ১৯৪৫ সালের পরমাণু বোমা হামলায় মৃতদের জন্য তৈরি শান্তি স্মারকে ইউ নেতৃত্ব সহ জি-৭ সদস্যদেরকে নিয়ে যাওয়ার প্রতীকী তাৎপর্য ছাড়াও গ্রুপটি একটি বিশেষ “পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের ব্যাপারে হিরোশিমা ভিশন স্টেটমেন্ট” ইস্যু করেছে। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় শুধুমাত্র দ্বিতীয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে জোসেফ বাইডেন হিরোশিমায় পা রেখেছেন। সম্মেলনের এটি একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সবাইকে অবাক করে দিয়ে পৌঁছেছেন। রাশিয়ার আক্রমণের ভয়াবহতার ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিবৃতি দিয়ে এই পরিস্থিতিতে মানবতার সঙ্কট বলে উল্লেখ করেছেন। এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার। জি-৭ সদস্যরা ইউক্রেনের ব্যাপারে আলাদাভাবে বিবৃতি দিয়েছে। তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরও নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে। তবে তারা দুই দেশের মধ্যে আলোচনা এবং যুদ্ধ থামানোর উপায় বাতলে দিতে পারেনি। এটা একটা ব্যর্থতা। খারাপ-ভালো নির্ধারণের প্রতি অপেক্ষাকৃত কম অগ্রাধিকারযুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি সহ এবারের সম্মেলনে ভারত, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া এবং ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কিশিডা সঠিকভাবেই গ্লোবাল সাউথের প্রসঙ্গটি তুলে ধরেছেন। শুধুমাত্র জি-৭ সদস্যরাই নয়, তার পাশাপাশি অন্যরাও যে বিশ্বের ব্যাপারে দুটি ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করে, সে ব্যাপারেও সম্মেলনের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
জি-৭ যদি নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তার করতে চায়, তবে তাদেরকে অবশ্যই এটা মানতে হবে যে, তাদের গোষ্ঠীটি প্রকৃত অর্থে আজকের বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করছে না। সংগঠনের বর্তমান সদস্যদের কাছে বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি সম্পদ রয়েছে, তবুও বিশ্বের জিডিপিতে জি-৭ দেশগুলোর এক তৃতীয়ংশেরও কম অবদান রয়েছে এবং সেই দেশগুলোতে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার দশভাগের মাত্র একভাগ বসবাস করেন। জাপান ছাড়া, জি-৭ দেশগুলোর চিন্তাভাবনা মূলত ইউরো-আমেরিকান দৃষ্টিভঙ্গির আশেপাশে ঘোরাফেরা করে। আপাতত তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গির দিগন্ত যে আর বড় হচ্ছে না, তা বলা যায়। বরং সংগঠনের আকার ছোট হয়েছে। রাশিয়া ২০০৮ সালে জর্জিয়ার একাংশ এবং ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করে। এর প্রতিবাদে সংগঠন থেকে রাশিয়াকে বিতাড়িত করা হয়। এছাড়া একটি ইকনমিক গ্রুপিং যে কতটা যুক্তিযুক্তি, তার স্বপক্ষে বক্তব্য রাখাও বেশ কঠিন হয়ে ওঠে। তার কারণ এতে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম দুটি অর্থনীতি (চিন এবং ভারত) অথবা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া জিডিপি বা বিশ্বের বৃহত্তম শক্তি সরবরাহকারীরা অন্তর্ভুক্ত নয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য স্বচ্ছ ফাইনান্সিং বা ঋণের নেতিবাচক প্রভাব থেকে বাঁচতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ অথবা বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমণের ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর ক্ষতিপূরণ প্রদানে জি-৭-এর ভূমিকার কথা হিরোশিমাতে উল্লেখ করা হয়েছে ঠিকই, তবে এই দায়িত্বগুলো তাদের পালন করার জন্য সুনির্দিষ্ট উপায়ের কথা সম্মেলনের বিবৃতিতে বলা হয়নি। চলতি বছরের শেষের দিকে জি-২০ সম্মেলনের দিকে স্পটলাইট পড়বে। এই প্রেক্ষিতে আশা করা যায় যে গ্রুপিংটি আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়ে উঠতে এবং আজ বিশ্ব যে সমস্যাগুলোর মুখেমুখি হয়েছে, সেগুলো মোকাবিলা করার জন্য সামগ্রিক আন্তর্জাতিক ঐক্যমত গড়ে তুলতে সচেষ্ট হবে।
COMMents
SHARE